হানিফ সংকেত আমাদের সবার কাছে অতি প্রিয় এবং পরিচিত একটি নাম। অনেক আগে হানিফ সংকেত-এর “যাহা বলিব সত্য বলিব” নামের একটি বই বের হয়েছিল। ছোটবেলায় এক বইমেলা থেকে আমাকে আমার আব্বু-আম্মু এই বইটা কিনে দিয়েছিল। এই বইয়ের প্রত্যেকটা গল্পই বেশ চমৎকার। যারা বইটি পড়েননি, তাদের জন্য সেই বই থেকে একটি গল্প এখানে তুলে ধরলাম। তাহলে আন্দাজ করতে পারবেন, বইটি কেমন মজার :)
তো শুরু করা যাক – ট্রাকের আত্মকাহিনী দিয়ে। একটি ট্রাক যাহা বলিব সত্য বলিব মর্মে তার আত্মকাহিনী আমাদের সবার সামনে উপস্থাপন করবে :)
আমার নাম ট্রাক। ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় আমার জন্ম। তবে কখন কোন তারিখে আমার জন্ম হয়েছিল তা আমি কি করে বলব? আমি কি আর সন তারিখের হিসাব জানি? তবে দুই নাম্বার তক্তা দিয়ে লোহার পেরেক ঠুকে যখন আমার পিছনে একটি শরীর তৈরি করা হইছিল তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার জন্ম কত যন্ত্রণাদায়ক। আমার গায়েও সুকুমার বৃত্তির চর্চা করা হয়; অনেক কথা লেখা হয়, অনেক শিল্পকর্ম স্থান পায়।যেমন: “সংকেত দিন, থামুন, ভেঁপু বাজান, সমগ্র বাংলাদেশ, পাঁচ টন”। ট্যাংকির গায়ে লেখা থাকে: “জন্ম থেকে জ্বলছি”। এছাড়াও মাঝে মাঝে বিরাট একটা ঈগল পাখি আঁকা হয়। এর যে কি অর্থ তা আমার জানা নেই। যদিও আমার গায়ে “ভেঁপু বাজান” লেখা থাকে তথাপিও আমার মত আমার অনেক জাত ভাইয়ের শরীরে কোন ভেঁপুই নেই।ব্যাটারী খরচ হবে বলে মালিক সেটা লাগায়না। তাই হেল্পার আমার গায়ে থাপ্পর মেরে মেরে ‘সাইডে সাইডে’ বলে। আমার খুব কষ্ট হয়। শরীরেও ব্যথা পাই। হেল্পারের জন্যও খারাপ লাগে এভাবে চিৎকার করতে থাকলে ওরতো ভোকাল কর্ড ছিঁড়ে যাবে! আহারে মানুষ শুধু একটা ভেঁপু লাগালেই কিন্তু সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। আমি যেন তাদের হাতের পুতুল, যখন ইচ্ছা হয়,আমাকে নিয়ে খাদে গর্তে ডোবায় চলে যায়। রাস্তায় যখন চলি তখন তখন রিক্সা,স্কুটার,টেম্পু, সিএনজি ধাক্কা দেয়া সহ শিশু পথচারীদের পিষ্ট করে নিয়ে যাই। আইল্যাণ্ড আর হাইল্যাণ্ড কোন কিছুই আমি বুঝতে চাইনা। অথচ আপনারাই বলুন এর জন্য দায়ী কে? আমি না আমার চালক? আমাকে যারা চালায় তারা কোন গতিসীমা মানেনা। অসীমের পানে যেন ছুটতে চায় তারা। কেন আমাদের এই জাতির ব্যাপারে তো আপনারাই আবার কৌতুক করছেন। স্পীডমিটার ছাড়া আমাকে চালাচ্ছিল এক চালক। কত মাইল বেগে আমাকে চালাচ্ছে সে তা বোঝে কি করে জিজ্ঞেস করাতে উত্তরে সে বলেছিল, ‘যখন শুধু বনেট কাঁপে তখন ২০ মাইল, যখন বনেট দুই দরজাসহ কাঁপে তখন ৪০ মাইল, যখঝন পুরো বডি কাঁপে তখন ৬০ মাইল। আর যখন আমি শুদ্ধ কাঁপি তখন ৮০ মাইল, এবার আপনিই বলুন এই ধরণের চালকের জন্য আমার বদনাম হবেনা কেন? ইদানীং আমি যেন তারকা হয়ে গেছি, পত্রপত্রিকায় আমাকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। আমাকে ‘ঘাতক’, ‘যন্ত্রদানব’ আখ্যা দেয়া হচ্ছে। আমার নামে কবিতা লেখা হচ্ছে। সেসব কবিতা আবার আবৃত্ত হচ্ছে রেডিও, টেলিভিশনে। কবিতার কয়েকটি লাইন শুনুন-
“আমি দুরন্ত, আমি দুর্বার
আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার।
আমি ঘাতক আমি দানব
আমি পিষ্ট করি মানব।”
কিন্তু এর জন্য দায়ীতো আমার চালক। আমার নিয়ন্ত্রক। কৈ তাকে নিয়ে তো কেউ কিছু বলেনা। তাকে কেউ বিচার করেনা। যখনই তাকে কিছু করা হয়, তাদের দাবির মুখে আবার কয়দিন পরে আবার তা তুলে নেয়া হয়। কিন্তু আমার বাকশক্তি নেই। কথা বলতে পারিনা। কোন প্রতিবাদ করতে পারিনা। তাই আমার এত কষ্ট। এত অপবাদ। আমার দু:খের কথা কি বলব? যারা আমাকে চালায়, তারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। আমাকে ব্যবহার করে সংসার চালায় অথচ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আমাকে একা বিপদে ফেলে পলাতক হয়। আর মারমুখী জনতা এসে আমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ এসে সেই অবস্থায় আমাকে গ্রেফতার করে। অন্য গাড়ির সাথে বেঁধে টেনে আমাকে থানায় নিয়ে যায়। হে বিধি, কার সাজা কে পায়! আমি কি কম কাজ করি- মালবহন তো করিই; তার ওপর আন্দোলনের মিছিলে আমার সংখ্যা যত বেশি হয়, তার প্রচার নাকি তত বেশি। ধর্মঘটের সময় আমাকে রাস্তায় আড়াআড়িভাবে রেখে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়। আমি অপবাদের স্বীকার হই। কাগজে আমার ছবি ছাপা হয়। অথচ যারা এর জন্য দায়ী,তার ছবি তো কখনো দেখিনি। কেউ কেউ টিপ্পনী কেটে বলে আমাকে নাকি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাই অকাতরে মানুয় মারছি। বলুন, এই অপবাদ কি সহ্য হয়? মাঝে মাঝে হেল্পার আমাকে চালায়। আমি জানি এক্ষুনি সে খাদে যাবে। কিন্তু আমার যে বাকশক্তি নেই, কিছুই বলতে পারিনা। মাঝে মাঝে রাস্তায় আমার সামনের দিক কাত হয়ে থাকে। মনে হয় এই বুঝি উল্টে যাব। মালিক আমাকে মেরামত করেনা। শোচনীয় অবস্থা হয়ে যায়।
এখন অবশ্য বিকালের আগে আমাকে শহরে ঢুকতে দেয়া হয়না। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে যতদিন আমার চালককে ঠিক করা না হবে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পরীক্ষা করা না হবে এবং আমার মালিক পয়সা খরচের ভয়ে আমার অসুবিধাগুলো বিশেষ করে ইঞ্জিনের অসুবিধাগুলো মেরামত না করবে, ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে। কারণ ১ ঘন্টা চলেও আমার দ্বারা ১০ ঘন্টার দুর্ঘটনা ঘটানো সম্ভব এদের মাধ্যমে। আর আমার ভাগ্যেও ঘাতক যন্ত্রদানব অপবাদ জুটতেই থাকবে। সে অপবাদের জন্য দায়ী আমি নই। আপনারা-হ্যাঁ আপনারা যারা মানুষ এবং আমার প্রভু, তারাই।