গতকাল হানিফ সংকেত-এর “যাহা বলিব সত্য বলিব” বইয়ের একটি গল্প পোস্ট করেছিলাম যার নাম ট্রাকের আত্মকাহিনী: যাহা বলিব সত্য বলিব । আজ তারই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় এবং এই বইয়ের আরেকটি গল্প পোস্ট করছি। এই বইয়ের জন্য এটাই আমার শেষ পোস্ট। আর কোন গল্প লিখে পোস্ট করার আপাতত কোন ইচ্ছে নেই।
তো শুরু করা যাক এবার – ইটের আত্মকাহিনী দিয়ে। কিভাবে বেচারা ইটেরা সকল কষ্ট সহ্য করে আমাদের বিল্ডিংগুলো দাঁড় করিয়ে রেখেছে এবং তাদের না বলা অব্যক্ত কথা জানা যাক —
পেটফাঁপা রুগীর পেটের মত ঢাকা শহর ক্রমশই উপরের দিকে উঠছে, পদতলে নোংরা শহর, ওপরে ফার্নিশড ফ্ল্যাট। এ জিনিস কেনাও যায়। ভাড়াও পাওয়া যায়। তবে প্রচুর ডানা ঝাপটা ঝাপটির প্রয়োজন হয়। আপনারাই উপরের দিকে তুলছেন আবার ডানা ঝাপটা ঝাপটিও করছেন। শুধু ব্যবহার করছেন আমাকে। নিষ্প্রান এবং বিবেক বুদ্ধি নেই বলে যা করছেন তাই মেনে নিচ্ছি। কারন আমি ‘ইট’। কারো ভাষায় ‘ইটা’, কারো ভাষায় ‘ইষ্টক’, আবার কারো কাছে ‘ব্রিক’। এ শহরের আনপ্ল্যানড ওয়েতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি। যেভাবে ব্যবহার করছেন সেভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছি। আমাকে দিয়ে ম্যালা কাজ করছেন আপনারা, যার আউটপুট হচ্ছে বেদনা, যন্ত্রণা, ফ্রাকচার, ম্যাসাকার, হাহাকার, কখনও বিকার আবার কখনও বা অন্ধকার। আপনারা যেমন মাটি দিয়ে তৈরি, আমরাও তেমনি মাটি দিয়ে তৈরি। আপনাদের ব্রেন আছে, আমাদের নেই। তাই ড্রেনেও আমাকে ব্যবহার করেন। আপনাদের ইচ্ছায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্থান থেকে ডাস্টবিন পর্যন্ত সকল স্থানেই আমি আছি এবং থাকব।
আমাকে খন্ড বিখন্ড করলেও নিঃশেষ হইনা। শুধু ভিন্ন নাম হয় আমার। ‘কংক্রীট’ কিংবা ‘খোয়া’।ব্যবহুত হই রাস্তায় কিংবা বাড়ির ফাউন্ডেশনে বা পিলার তৈরিতে। আমার আবার শ্রেণীবিন্যাস করেছেন আপনারাই। “সিরামিকের ইট”, ১, ২ ও ৩ নম্বর ইট। এলাকা বিশেষে বিরাট বিরাট লাল দালান বানিয়েছেন। আমাদেরই উন্নত জাত ভাইদের ব্যবহার করে। ‘সিরামিক’ নাম দিয়ে বিশেষ ধরণের ক্যামিকেল মিশিয়ে চকচক করে আমাদের মুখোশ পাল্টে আমাদের এ জাতিকে স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ইদানীং এ জাত ভাইদের সাথে আমাদের নতুন হাইব্রিড জাত ভাই মোজাইক ও টাইলস সদর্বে শেয়ার নিয়ে নিয়েছে।
নিজেরাতো বেশ মুখোশ পাল্টাতে পারেন। এখন আবার আমাদের নিয়ে শুরু করেছেন। খুব মাইন্ড করলেন মনে হচ্ছে। কেন এক একটা নির্বাচন আসে, জমানা পাল্টায়। কিন্তু মানুষের ভাগ্য পাল্টায়না। শুধু কিছু অজগরের সৃষ্টি হয়, হাঁ করে থাকে। খালি গেলার আগ্রহ, বাড়ি হয়, গাড়ি হয়,লাইসেন্স হয়, পারমিট হয়। আপনাদের সম্পর্কে এক কথায় বলা যায়, আপনারা অন্যের অসুবিধা বোঝেননা। তবে নিজের সুবিধা বুঝেন ষোলো আনা। আপনাদের হিসেব হলো একদল খাবে, আর একদল উপোস করবে। কেউ গাড়ি চড়বে, কেউ গাড়ি চাপা পড়বে। কেউ বাড়িওয়ালা হবে, অথচ যারা বানায়, তাদের বলেন রাজমিস্ত্রী। কি উপহাস! রাজার মজা তাদের ভাগ্যে নেই, তথাপিও নামের আগে রাজ বসিয়েছেন। পারেনও ভাই।আমি আপনাদের কল্যাণে সব জায়গাতেই থাকি। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, শিল্পে, রাস্তায়, বাড়িতে, ডাস্টবিনে, নর্দমায়, পাঁচতারায়, এমনকি টয়লেটেও। আপনারা বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। এই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে আমাকে “মাল্টিপারপাস” পদার্থ বানিয়েছেন। নিরবে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছি। কখনও কখনও অসহায় টোকাইয়ের মাথার বালিশ হই। দুঃখ পাই, ব্যথায় মনটা কেঁদে উঠে। আরো দুঃখ লাগে যখন দেখি, আমাকে ঘিরে যখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার কারনতো আমি নই, কারন আপনারাই ভেজাল জিনিস দিয়ে আমাকে বানান।
আপনাদের দু’পয়সা হাতানোর কারণে সেই ভেজাল আমাদের জাত ভাইদের দিয়ে বানানো ইমারত কয়েক বছর পর কাৎ হয়ে যায়। ধসে পড়ে মৃত্যুবরন করে অনেকে। দোষ হয় আমাদের। জ্বালানি খরচের ভয়ে আমাকে মজবুত করে পোড়ানো হয়না। যার ফলে বেশি ভিজলে নরম হয়ে যাই। কোন রক্ষণাবেক্ষন না করার ফলে ৭/৮ বছর পর ধসে পড়ি। আমাদেরও তো একটা জীবন আছে! মাঝে মাঝে ‘ফুয়েল’ দেওয়া প্রয়োজন। সেটা ভুলে যান। আমি আপনাদের উপকার করার জন্যই জন্মেছি। কিন্তু বুক ফেটে কান্না আসে- যখন দেখি আমাকে ছুড়ে আর একজনের মাথা ফাটিয়ে ফেলেন। আশ্চর্য লাগে ভেবে-আপনারাই নাকি সৃষ্টির সেরা জীব? হে বিধি- তুমিই জান এর জবাব।
সব আমলে সব ধরণের আন্দোলনের সময়ই আমাকে ব্যবহার করে গাড়ি, কাঁচের জানালা, আরো বিভিন্ন জিনিস ভাংচুর করা হয়। তখন কষ্ট হয় আমার। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় চিৎকার করে বলি- আমার জন্ম হয়েছে সৃষ্টি করতে, গড়তে, ভাঙতে নয়। আমাকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে অপরাধী করবেননা। ভাইসকল! কে শোনে কার কথা! কারন ক্রাইম আর ভায়োলেন্স -ইদানীং আপনাদের কাছে ম্যানলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আচ্ছা ভাই, আপনাদের মধ্যে কি মায়া মোহাব্বত, প্রেম-প্রীতি বলে কিছু নেই? যে গাড়িতে আমাকে ছুঁড়ে মারবেন, সেই গাড়িতে একটি ছোট্ট শিশু থাকতে পারে। থাকতে পারে কোন অসুস্থ মা। ফলে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। আপনাদের কি একটুও চিন্তা হয়না? ছিন্নমূল টোকাইদের কাজটি করতে বেশি দেখা যায়। জিজ্ঞেস করলে বলে,” স্যারেরা কইছে”। স্যার-কেন এ সমাজটাকে ছারখার করছেন? আপনারা তো মানুষ। পশু নন। দ্বিপদ। চতুষ্পদ নন। এ প্রসঙ্গে একটা একটি গল্প মনে পড়ে গেল-
একবার এক মানসিক ডাক্তারের কাছে একজন রোগী গিয়েছেন। ডাক্তার সাহেব তাকে প্রশ্ন করলেন, “কি সমস্যা আপনার?”
রোগী: ডাক্তার সাহেব, একটা প্রশ্নের উত্তর দেনতো?
ডাক্তার: প্রশ্নটি কি?
রোগী: আচ্ছা আমি দ্বিপদ নাকি চতুষ্পদ? কারন আড়ালে আবডালে অনেকেই আমাকে পশু বলে।
ডাক্তার: আপনার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলেন।
রোগী: সংক্ষেপেই বলি- বদনাম রটাতে আমার ভালো লাগে। অন্যের ভাল দেখলে অস্থির লাগে। আর আমি যেটা করি সেটা ঠিক মনে হয়। এবার বলেন আমি কি দ্বিপদ নাকি চতুষ্পদ?
ডাক্তার: আকৃতিতে আপনি মানুষ অর্থাৎ দ্বিপদ, কিন্তু প্রকৃতিতে অর্থাৎ আচরণে মনে হচ্ছে আপনি চতুষ্পদ। তাই আড়ালে আবডালে আপনাকে লোকে ঐ নামে ডাকে।
যাক ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম, কিছু মনে করবেননা। আমার একটিই কথা- যে কাজ করার জন্য এই পৃথিবীতে জন্মেছি, সে কাজ করতে দিন। আমাকে অপব্যবহার করে বদনামের ভাগীদার করবেননা। আমি আপনাদের ভালোবাসা চাইনা। কারণ আপনারা যতদিন নিজেরা নিজেদেরকে ভালোবাসবেন না,ততদিন পর্যন্ত আমার ভালোবাসা প্রত্যাশা করা দুরাশাই হবে। তবে অনুরোধ একটাই- মানুষের সত্যিকার কল্যানে আমাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করুন।।